শিক্ষায় গণিত অলিম্পিয়াড এবং এর কৌশল প্রয়োগ || Math Olympiad and applying it's strategy in education
বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড
যেকোন ধরনের সমস্যাকে যৌক্তিক ধাপে বিন্যস্ত করে সমাধানের উপায় বের করার জন্য প্রধান ভরসা গণিত। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন গণিতের শক্ত ভিত্তি। জাতি হিসেবে সমস্যা সমাধানে দক্ষতা অর্জনের হাতিয়ার গণিতে দক্ষ হয়ে ওঠা। এই দক্ষতা অর্জন শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে এর সমান গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
গণিত অলিম্পিয়াড একটি প্রতিযোগিতা, যা শিক্ষার্থীদের গণিতে দক্ষতা এবং আগ্রহ বাড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গণিতের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি শিক্ষার্থীদের গণিতে দক্ষতা এবং আগ্রহ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি থেকে ২০০১ সালে শুরু করে এক আন্দোলন।
তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা এতে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি এর আয়োজন করে থাকে। দৈনিক প্রথম আলো এবং ডাচ-বাংলা ব্যাংক অলিম্পিয়াড আয়োজনে সহায়তা দিয়ে থাকে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজিত হয়। তখন থেকে প্রতি বছরই নিয়মিতভাবে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই অলিম্পিয়াড দুটি স্তরে সম্পন্ন হয়ে থাকে: বিভাগীয় উৎসব ও জাতীয় উৎসব। বিভাগীয় উৎসবে নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রীরা জাতীয় উৎসবে অংশ নেয়। জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীদের নিয়ে গণিত ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়, আর সেখানে থেকেই বাছাই করা হয় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের জন্যে বাংলাদেশের জাতীয় গণিত দল।
গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের ক্যাটাগরী
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে কেবল প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু দেশে গণিতকে জনপ্রিয় করার জন্য প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করা হচ্ছে। এই পর্যায়ের ছাত্র
ছাত্রীদের ৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। ক্যাটাগরিগুলো হলো-
১. প্রাথমিক (৩য় শ্রেণি-৫ম শ্রেণি)
২. জুনিয়র (৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণি)
৩. মাধ্যমিক (৯ম-এএসসি পরীক্ষার্থী)
৪. উচ্চ মাধ্যমিক (১১শ-১২শ শ্রেণি)
তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে, জাতীয় গণিত ক্যাম্পে কোন ক্যাটাগরী নেই। সবাইকে একই পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়।
শিক্ষায় গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতি
গণিত একটি বিমূর্ত বিষয়। গণিতকে আলাদাভাবে কোন বিষয় (Subject) হিসেবে ভাবা হয় না। গণিত হল একটি ‘টুল’, যা সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি মনে করে, গণিত হচ্ছে সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার। গণিতে দক্ষতা অর্জন করলে যৌক্তিকভাবে কোন একটি সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা তৈরি হয়। গণিতে কোন একটি ধারণা (Concept) আয়ত্ত্ব করা বা শিখার হচ্ছে ওই ধারণা ব্যবহার করে পরবর্তীতে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ভূগোল বা দৈনন্দিন যেকোন বিষয়ে সমস্যা সমাধানে ওই ধারণা ব্যবহার করতে পারবে।
Download all Math Olympiad Content Delivery Book
সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শেখা
কোন একটি ধারণা শিখে যাতে শিক্ষার্থীরা অন্য যেকোন জায়গায় একই ধরনের উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ধারণাটি ব্যবহার করে তা সমাধান করতে পারে এজন্য কোন একটি ধারণা সরাসরি শিখিয়ে না দিয়ে একটি সমস্যা প্রদানের মাধ্যমে ধারণায় যাওয়া উচিত। অর্থাৎ সমস্যা সমাধান করতে করতেই নতুন নতুন ধারণা শিখবে।
অনুশীলন ও সমস্যা
গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি 'অনুশীলনী' ও 'সমস্যা'র মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য করে। অনুশীলনী হচ্ছে এমন গাণিতিক সমস্যা যা নির্দিষ্ট উপায়ে সমাধান করা যায় এবং সমাধানের ধাপগুলো সুস্পষ্টভাবে জানা থাকে।
যেমনঃ যোগ প্রক্রিয়া।
সমস্যা হল এমন একটি বিষয় যা শিক্ষার্থীদের জানা ধারণা (কনসেপ্ট) দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু ওই সমস্যাটি সমাধানের প্রক্রিয়া কী হবে তা সুস্পষ্টভাবে শিক্ষার্থীদের জানা থাকে না। সমস্যাটি সমাধান করতে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে চেষ্টা করতে হয়। চেষ্টা করতে গিয়ে নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। একটি সমস্যা সমাধান করতে হয়ত অনেক সময় লেগে যেতে পারে, অনেক অসময় কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে। তবে এভাবে যে দক্ষতা তৈরি হয় তা-ই মূলত গণিত শেখার মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা।
গণিত ভীতি নয়, গণিত আনন্দের
গণিত অলিম্পিয়াডের বড় একটি সাফল্য গণিত ভীতি দূর করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা। গণিতের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে গণিত অলিম্পিয়াড গণিতের ভেতরের সৌন্দর্য শিক্ষার্থীদেরকে দেখিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা একবার গণিতের সৌন্দর্য অনুধাবন করতে পারলে গণিতের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে, আনন্দে নিজেই গণিত শিখতে আগ্রহী হয়।
এস্টিমেশন ও পেশ্চিমেশন
গণিত অলিম্পিয়াড শিক্ষার্থীদের এস্টিমেশন ও গেস্টিমেশনে দক্ষ করে তুলতে চায়। শিক্ষার্থীরা যাতে গণিত বইয়ে পড়া ধারণা গণিত বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব জীবনে ব্যবহার করে, কোন একটা সমস্যাকে যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে সহজেই একটা সমাধানে পৌঁছাতে পারে সেজন্য এই পদ্ধতি অনেক বেশি কাজে আসে।
শিক্ষকের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন
গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি পাঠদানের ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় গভীরভাবে বিশ্বাস করে, শিক্ষককে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতে হবে। শিক্ষক পূর্ণ স্বাধীনতা পেলেই শুধু সমস্যা সমাধান করিয়ে, বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে, গল্প করে, ধাঁধাঁ দিয়ে একটি ক্লাসকে আনন্দদায়ক, ফলপ্রসু করে তুলতে পারবেন। তাঁকে ছকে বেধে দিলে তিনি তোতাপাখির মত বুলি আওড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যা শিক্ষার্থীদের উপকারে আসবে না।
গণিতের এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয় ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশ দল অংশ নেয় বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান এ মেধার লড়াইয়ে। অপরদিকে ২০০৩ সাল থেকে এই কমিটি আয়োজন করছে জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড। জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড এখন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশেষ উৎসব। একসঙ্গে গণিত অলিম্পিয়াডের শিক্ষার্থীরা দেশে এবং বিদেশে বিশেষ মেধার স্বাক্ষর রাখছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণিত অলিম্পিয়াডের শিক্ষার্থীদের পদচারণা এখন নিয়মিত ঘটনা। ২০১৮ সালে এসে বাংলাদেশ গণিত দলের সদস্য জাওয়াদ আহমেদ চৌধুরী অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের সর্বোচ্চ সম্মান স্বর্ণপদক। এছাড়াও গণিতের জাগরণকে মুখরিত রাখতে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড, নিজস্ব ব্লগ এবং গণিত ক্লাব ও ফোরাম চালু করেছে। এসকল ফোরাম ও ক্লাবে গণিত বিষয়ে নানা সমস্যার আলোচনা ও সমাধান করা হয়।
Download Math Olympiad Master Trainer Manual
বর্তমানে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব মুনির হাসান।
গণিত অলিম্পিয়াড কৌশলঃ
গণিত অলিম্পিয়াড কৌশল হচ্ছে আনন্দে গণিত শিক্ষার এক অনন্য পদ্ধতি। গণিত অলিম্পিয়াড কৌশলের বিশেষত্বসমূহ হলো:
১। আনন্দময় শ্রেণি কার্যক্রম: গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতির প্রধান উদ্দেশ্য গণিত শিক্ষার জন্য আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করা। গণিত ভীতি আমাদের দেশে গণিত শিক্ষার উন্নয়নের অন্যতম বড় অন্তরায়। তাই বিভিন্ন রকম মজার খেলা, গণিতের গান, গল্প, ধাঁধাঁ, ম্যাজিক ইত্যাদি আনন্দদায়ক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে গণিত ক্লাসকে একটা আনন্দের জায়গা হিসাবে উপস্থাপন করতে হবে। তাছাড়া গণিতকে শুধু শ্রেণিকক্ষের গণ্ডিতে আটকে না রেখে প্রয়োজনে শ্রেণিকক্ষের বাইরেও নানারকম কাজের মাধ্যমে গণিত ভীতির বদলে গণিত মানেই আনন্দ- এই ধারণাটা শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে দিতে হবে।
২। বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গণিত: দৈনন্দিন জীবনের সাথে গণিতের সম্পর্ক স্থাপন এই পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। গণিতকে শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখানো হয়। প্রাত্যহিক জীবনে গণিতের বাস্তব প্রয়োগ দেখানোর লক্ষ্যে নানারকম গল্প এবং কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন বাস্তব সমস্যার অবতারণা করা হয়।
৩। সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন ভাবনা: গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য বারবার একটি সমস্যা সমাধানের চেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানো এবং চিন্তার বৈচিত্র্যের ধারণা দেওয়া। এজন্য শুরুতে শিক্ষার্থীদের জন্য একটা বাস্তব সমস্যা সমাধান করতে বলা হবে। কিন্তু প্রথমেই সরাসরি সমাধানের উপায় বা সূত্র বলে দেওয়া চলবে না। তাহলে তারা এটাকে অনুশীলনীর মতো ভেবে শুধুমাত্র সমাধান পদ্ধতি মনে রাখবে। তাই, শিক্ষার্থীদের ইচ্ছেমতো বারংবার চিন্তা করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং খুব প্রয়োজনে সমস্যাটা বুঝিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর কোন চিন্তাকেই সরাসরি ভুল বা অবাস্তব বা অসম্ভব বলে তাচ্ছিল্য করে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। সবরকম চিন্তাই শুরুতে গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে এবং পরবর্তীতে ভুল নাকি সঠিক সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে। কারণ, একটা চিন্তাকে শুরুতেই ভুল বলে দিলে শিক্ষার্থী চিন্তা করার আগ্রহ হারাবে। অন্যদিকে, চিন্তাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে ব্যাখ্যা করে বুঝালে শিক্ষার্থী পরবর্তীতে আরো চিন্তা করতে আগ্রহী হবে। আর এভাবেই শিক্ষার্থীরা একটি সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন উপায়ে চিন্তা করতে শিখবে।
৪। প্রশ্ন করা: ‘প্রশ্ন করা হল’ চিন্তার ফসল আর জানার পূর্বশর্ত। তাই গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর প্রশ্ন করার অধিকারকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নানামুখী চিন্তার মাধ্যমে সকল শিক্ষার্থীর মনে হাজারো প্রশ্ন আসবে। শিক্ষকের অবশ্য কর্তব্য সেগুলোর যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা। উত্তর না জানা থাকলে সময় নিয়ে সঠিক উত্তর জেনে তারপর জানানো ভালো। কিন্তু কখনোই প্রশ্ন করাকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না।
৫। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক: গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তরিক সম্পর্ক। অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে প্রশ্ন করা বা নিজের চিন্তাভাবনা জানাতে লজ্জা বা ভয় পায়। এমন হলে কিন্তু উপরে আলোচিত কোন পদক্ষেপই তেমন ফলপ্রসূ হবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষককে গণিতের বিভিন্ন ধাঁধাঁ, গল্প বা ম্যাজিকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য বিভিন্ন কাজ, খেলা, ফান/পাজেল ইত্যাদিতে তাদের সাথে শিক্ষক নিজেও অংশগ্রহন করবেন। ফলে শিক্ষার্থীদের নিকট শিক্ষকের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। এবং শিক্ষকের কাছে সহজেই শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন এবং চিন্তাভাবনা জানাতে আগ্রহী হবে।
No comments
If you have any question, Please let me know.